Wednesday, February 14, 2007

অলকানন্দা জলে

সকাল সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। গড়িয়াহাট জংশনের চৌরাস্তার মোড়ে থিকথিক করছে ব্যস্ত মানুষের ঢল। কেউ বা বাসের অপেক্ষায়, কেউ বা রাস্তা পার হবে ব’লে চৌমাথার ফুটপাথে ভিড় করে আছে। সেই ভিড়ের মধ্যে বছর কুড়ির একটা ছেলেও দাঁড়িয়ে আছে। সে কলেজ যাবে। দশটা থেকে শুরু হয়ে যাবে তার ক্লাস। প্রায় কুড়ি মিনিট হোল সে দাঁড়িয়ে আছে। যে বাসের জন্য সে অপেক্ষা করছে সেই রুটের বাস ঠিক দশ মিনিট আগেই চলে গেছে। তার কলেজ যেখানে, সেখানে ঐ একটা রুটেরই বাস যায়। কিন্তু সে আগের বাসটা ধরেনি। আগের বাসটা বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই সে খুব মন দিয়ে বাসের জানলাগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছে, কিন্তু বাসটাতে ওঠার কোনও চেষ্টাই করেনি। বোধ হয় কারুর জন্য সে অপেক্ষা করছে। রোগা পাতলা ছেলেটার গায়ে একটা হাত-গোটানো, লাল-কালো রঙের ডোরাকাটা ফুলশার্ট আর পায়ে কালো জিন্স। অস্থির চোখ দুটো দিয়ে সে কাকে যেন খুঁজছে। বোঝাই যাচ্ছে- কলেজে যাওয়ার আগে কারুর সঙ্গে দেখা করবে, আর তার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই হয়ত সে আগের বাসটা হাতে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে। এ-বয়সের কলেজ-পড়ুয়া ছেলে সন্ধানি চোখ নিয়ে রাস্তায় এগিয়ে চলা ভিড়ের মধ্যে কাকে খোঁজে তা বলতে পারার জন্য কোনও বিশেষ মেধার দরকার হয়না। ছেলেটা এবার একটু অধৈর্য্য হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে। বেশি সময় আর নেই তার হাতে। যার জন্য অপেক্ষা তার, সে যদি এখনই এসে না পড়ে তাহলে তার দেরি হয়ে যাবে কলেজ পৌঁছতে। সে হয়ত চায়না তার দেরি হোক। তাই সে একটু অশান্ত হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। একটু আগেও তার মধ্যে কোনও অস্থিরতা দেখা যায়নি। সে এখন বারবার গলা উঁচু করে, একটু দূরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, ছেলেটা কিন্তু দূরে তাকিয়ে কোনও মানুষের আসা যাওয়া লক্ষ্য করছে না। সে দেখছে দূর থেকে আসা বাসের নম্বর। যে রুটের বাসটা তার কলেজের পাশ দিয়ে যায়, সেই বাসটা আসছে কি না সেটা দেখার চেষ্টা করছে। বহুদূর থেকে যদি সেই নম্বরটা সে একবার পড়ে ফেলতে পারে তাহলেই যেন তার শান্তি। বাসটা অতদূর থেকে তার কাছে এসে পৌঁছতে যে দু-এক মিনিট সময় নেবে সেই সময়টুকু সে বিনা উত্কণ্ঠায় উপভোগ করতে চায়। এ-বয়সের ছেলেদের হাব-ভাবই বড় অদ্ভুত। আগের বাসটা ছেড়ে দিয়ে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে পরের বাসটা ধরবে ব’লে। হয়ত সে যা’র অপেক্ষা করছে সে আসছে এই বাসেই। ছেলেটা মনে হয় জানত আগে থেকেই। তাই হয়ত আগের বাসে ওঠেনি। ছেলেটা এবার নিশ্চিন্ত হোল। সে দূর থেকে দেখতে পেয়েছে বাসের নম্বর। মাঝখানে দু’মিনিটের সেই নিশ্চিন্ত অপেক্ষা। তারপর বাস এসে দাঁড়াল সামনে। বাসটা লোক নেওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে এখানে। ছেলেটা কিন্তু বাস আসতেই উঠে পড়ল না। সে বাসের জানলা গুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকাল। যে ক’টা মুখ, যে ক’টা পিঠ চোখে পড়ল দেখল কিন্তু খুশি হতে পারল না যেন। যাকে সে দেখতে চেয়েছিল, তার বসে থাকার কথা ছিল বাসটার একটা বিশেষ জানলার ধারে। কিন্তু আজ সেখানে অন্য মুখ। যারা বাসে ওঠার, উঠে পড়ল। বাস ছেড়ে দেবে এবারে। ছেলেটাও মাথা নিচু করে উঠে পড়ল সামনের দরজা দিয়ে। তার মুখ দেখে বোঝার বিশেষ উপায় নেই সে কি ভাবছে। সে কি হতাশ, না কি বেদনার্ত, না কি রাগে ফুঁসছে, না কি শুধুই অভিমান করেছে- সেটা তার মুখ দেখে বোঝা যাবে না। তার চোখে-মুখে একটা উদাসীন ভাব থাকে সবসময়। আর মাঝে মাঝে একটা উত্কণ্ঠার ছাপ। এর বাইরে কোনও অভিব্যক্তির ভাব তার চোখে-মুখে ফোটে না। তার মুখ এখন নির্বিকার। বাস আসার উত্কণ্ঠা কেটে গেছে, তাই এখন সে আবার উদাসীন।

বাসের মধ্যে হাল্কা ভিড়। ছেলেটা বাসে উঠে একবার সেই বিশেষ জানলাটার দিকে তাকিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, শক্ত করে রড ধরে দাঁড়াল। তার মনের মধ্যেটায় কেমন করে উথাল-পাথাল হচ্ছে, কত চাপা কান্নার স্রোত বয়ে যাচ্ছে, পাশের কেউ তা জানতেও পারবে না। সে কি যেন একটা আশা করে এসেছিল। আজকে যেন সে ব্যর্থ হতে চায়নি। শুধু আজকের দিনটা। এই পথে, এই বাসে করে সে কোনও দিনও কলেজ যায় না; কিন্তু সে আজকেই যেতে চেয়েছিল। যাকে দেখবে ব’লে সে এই বাসটা ধরতে চেয়েছিল, সে এই বাসে আসেনি। ছেলেটা চুপচাপ একটা কবিতার লাইন ভেবে যাচ্ছে। সে কবিতা ভালবাসে। যখন তার খুব দুঃখ হয় সে এক-একটা কবিতার লাইন ভাবে। রড ধরে দাঁড়িয়ে তার মাথায় জয় গোস্বামীর লেখা একটা কবিতার লাইন মাথায় আসছে। সে বার বার মনের মধ্যে আওড়াচ্ছে সেই লাইন- “....হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে”। ভাবতে ভাবতে সে একবার পিছন ফিরে তাকাল বাসের অন্য ধারের জানলার দিকে। সে দেখতে পেল কালো সোয়েটার আর লাল রঙের লম্বা স্কার্ট পরা একটা মেয়ে বাসের মাঝামাঝি একটা টানা সিটে জানলার দিকে পিছন ফিরে বসে পাশের এক মহিলার সঙ্গে কথা বলে চলেছে। এই সেই মেয়ে, যার জন্য ছেলেটা এই বাসে চেপেছে। মেয়েটা তারই কলেজে পড়ে, রোজ এই বাসে করেই যায়। এই বাসটারই একটা বিশেষ জানলার ধারে মেয়েটা বসে রোজ। আজ মেয়েটারও একটু দেরি হয়েছিল। তার নিজস্ব সিট বেদখল হয়ে গেছে। তাই অন্য সিটে বসে পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে গল্প করছে। তাই ছেলেটা বাসে ওঠার আগে মেয়েটাকে দেখতে পায়নি। সে একবার বাসের অন্য লেডিজ-সিট গুলোতেও চোখ বুলিয়ে দেখেছে। দেখতে পায়নি, কারণ মেয়েটি আর মহিলাটি আজ লেডিজ সিটে জায়গা না পেয়ে ছেলেদের সিটে গিয়ে বসেছে। ছেলেটা এবার খুঁজে পেল মেয়েটাকে। আর একটু হলেই কেউ কাউকে দেখতে পেত না। আর একটু হলেই ছেলেটার হৃদি অলকানন্দার জলে প্রায় ভেসে গিয়েছিল। মেয়েটা কিন্তু জানে না যে ছেলেটা আজকে তার জন্যই এই বাসে উঠেছে। আজ মেয়েটার অবাক হওয়ার পালা। মেয়েটা তার ব্যাগে বই-খাতার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে আর্চিসের লাল পান আঁকা রঙীন কার্ড, আর পান পাতার আকারের ছোট ছোট চকোলেট। আর ছেলেটা তার ব্যাগে নিয়ে যাচ্ছে ওরকমই একটা রঙীন কার্ড আর কয়েকটা ছোট্ট খেলনা পুতুল। ওরা কলেজে গিয়ে একে অপরকে ঐ জিনিসগুলো দেবে। কিন্তু তার থেকেও বড় পাওনা হবে আজকের দুজনের এই এক বাসে দেখা হওয়াটা। যা এর আগে কোনও দিন হয়নি। আর হবে কি না তাও কেউ জানে না। অথচ, আর একটু হলেই তারা একই জায়গায় একই বাসে করে যেত কিন্তু একাকী। অন্য কোনও দিন হলে না হয় মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু আজকে কিছুতেই তা মানা যায় না। কেন, কি দিন আজ? ছেলেটার হাতের ঘড়িতে তারিখ দেখাচ্ছে- চোদ্দই ফেব্রুয়ারি। আজ যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে। আজকে কি হৃদিকে অলকানন্দার জলে ভেসে যেতে দেওয়া যায়?

1 comment:

AG said...

So Cute. so very cute.